Friday, September 10, 2010

শিল্পী নিলুফার চামান


অনুভূতিতে মানুষ কাদেঁ, অনুভূতিতে মানুষ হাসে, এ কারনেই সারা পৃথিবীর মানুষের অনুভূতি প্রকাশের ধরন এক।এমন অগুনিত মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে শিল্পীরা। ভাগ্যবান তারা একদিকে কেননা হাসি, কান্নার গন্ডি পেরিয়ে অন্যসকল বিবিধ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ তারা ঘটাতে পারে শিল্পে অনুগ্রহ পেয়ে। এমনতর একজন শিল্পী নিলুফার চামান।

যন্ত্রসভ্যতার অপরিমেয় বিকাশ ঘটেছিল মানব সভ্যতায় শিল্পবিপ্লবের পরে। যন্ত্র মানুষের হাতে এনে দিয়েছিল ঈশ্বরের শক্তি। গায়ের যে প্রয়োজনীয় জামাটি তার তৈ্রী করতে লেগে যেত কয়েক সপ্তাহ সেই প্রয়োজন যন্ত্র মিটিয়ে দিল কয়েক মুহূর্তে তাও কয়েক হাজারটি একই সময়ে। কিন্তু সভ্যতারদ্রুত পরিবর্তনের দ্রুততার সাথে মানুষ যে ব্যাপারটি অনুধাবন করলো তা হচ্ছে প্রকৃ্তির সাথে তার সম্পর্কহীনতা। প্রকৃ্তির অমোঘ নিয়মে রোদ, ঝড়, বৃষ্টি তাকে আর স্পর্শ করে না। রোদে ছাতা, বৃষ্টিতে কোট তাকে খুব সহজেই মুক্ত করলো প্রকৃ্তির স্পর্শ থেকে। চরম কৌশলের সাথে মানুষ পৃথিবীপ্রকৃ্তির ভেতর থেকে তৈরি করলো তার নিজসব্ আরেক পৃথিবী। এই পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষের পুকুরে কিংবা নদীর কাছে যেতে হয় না পানি আনতে, সূর্যের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না আলো নিতে। উনবিংশ শতকের কলকাতা সম্পর্কে এ কারনে গ্রামগঞ্জের লোকের বুলি ছিল “আজব শহর কলকাতা, দেয়াল টিপলে আলো জ্বলে, দেয়াল টিপলে জল পরে।’’
এমনতর সময়েই যন্ত্রসভ্যতার বিড়ম্বনাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় চ্যাপলিন(Chaplin)এর Modern Times এবং ফারনান্দ লেগার(Fernand Leger) এর Bellet Mecanique। এই যন্ত্রসর্বস্ব বিশ্বের কাছ থেকে মুক্তির প্রচেষ্টা মানুষ করতে চাইলো যন্ত্রকে আবিষ্কারের কিছুকাল পর থেকেই। কারন সে অনুধাবন করল, যন্ত্র তার ও প্রকৃ্তির মাঝে অদৃশ্য কিন্তু প্রকান্ড অস্থিত্বের এক দেওয়াল হয়ে দাড়িয়ে আছে।

নীল আকাশ
নীল মাটি
নীল সমুদ্র
অথবা
সবুজ আকাশ
সবুজ মাটি
সবুজ সমুদ্র ***
***( নিলুফার চামান, প্রতিদিনের গল্প, ক্যাটলগ ১৩ জুন ১৯৯৮ এর প্রদর্শনী )


ব্রিটিশরা সভ্যতার আলো দেখানোর অজুহাতে সমগ্র বিশ্বের প্রভুত আদি সমাজের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। আবার হয়তো একারনেই সভ্যতার যন্ত্রের আগ্রাসনের সামনে প্রহসন হয়ে জন্ম নিয়েছিল কন্সটেবল টার্নার প্রভৃতি ব্রিটিশ রোমান্টিক শিল্পীর। বিংশ শতকের প্রারম্ভে জন্ম হল ভাস্কর হেনরি মুর এর এবং অল্প কয়েক দশকের ব্যবধানে জন্ম নিলেন শিল্পী রিচার্ড লং। এই দুই শিল্পীর ক্ষেত্রে যে ব্যপারটি এক, তা হল এরা দুইজনই প্রকৃ্তির প্রতি অনুরক্ত। এই অনুভবের বহিঃপ্রকাশে মুর গাছ, মানুষ, পাথর এর ফর্ম কে এক করে মুর্তি গড়লেন আর লং মানুষ আর প্রকৃ্তির মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য গাছ ও পাথর খন্ডকে গ্যলারীর মধ্যে নিয়ে আসলেন।

--------------------------------হেনরি মুর--------------- রিচার্ড লং

শিল্পী নিলুফার চামান,পাকিস্থানে করা একটি কাজ, উপাদান-কাগজ ও রঙিন পাথর, ২০০১।

আমাদের বাংলাতে শিল্পী ও সাহিত্বিকদের মধ্যে প্রথমে রবীন্দ্রনাথ ও পরে কে জি সুব্রমনিয়াম ক্রিয়েটিভ সার্কেল এর কথা বলেন। এই তত্ব অনুসারে, সমসাময়িক পৃথিবীর দুই প্রান্তে একই সময়ে বসবাসরত দুজন মানুষ একই ভাবনাতে প্রসমিত হতে পারে তাদের মধ্যে যোগাযোগ না থাকার পরেও। হেনরি মুর, রিচার্ড লং প্রভৃতি শিল্পী ছাড়াও শান্তিনিকেতন এ অধ্যয়নে থাকাকালীন সময়ে বিখ্যাত ভারতীয় ভাস্কর রামকিংকরের কাজ শিল্পী নিলুফার দেখছেন খুব কাছ থেকে। ভাস্কর রামকিংকরের পরিবেশ সচেতন নির্মিত ভাস্কর্যগুলো ছাড়াও শিল্পী এই সময় শান্তিনিকেতনের প্রকৃ্তিকে দেখছেন খুব নিবিড় থেকে। হয়তো এই সময়ই রবীন্দ্রনাথ এর আর্দশের প্রেম ও প্রকৃ্তি শিল্পী নিলুফার চামানের শিল্পসত্তায় মিশে যায়। প্রকৃ্তি সম্পর্কে শিল্পীর অনুভুতি স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন তাঁকে এব্যপারে প্রশ্ন করি, তার উক্তিতে “দেখ প্রকৃ্তি ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত চলতে পারি না। আমার বাড়িটি এমন জায়গায় যার বামে জলাশয় ডানেও জলাশয়, আর উপরে দিগন্ত বিসৃত আকাশ। আমরা কি পারি প্রকৃ্তিকে অস্বীকার করতে?’’
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রর্দশনীর ক্যাটলগটি ছিল মাটির রঙের। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে হওয়া একক প্রদর্শনী যে দুই ভাজের ক্যাটলগ হয় তাতে তিনি তিনটি পৃষ্টাতে মাটি, পানি ও বায়ু (আকাশ) কে উপস্থাপন করেন সবুজ রঙে, যেন শিল্পীর কল্পনার রঙে প্রকৃ্তির তিন মৌ্লিক উপাদানের রুপান্তর ঘটেছে। এবং সেই কল্পনার রংটি হচ্ছে সবুজ যা উর্বরতার প্রতীক। যেন শিল্পীর দৃষ্টিতে সমগ্রপৃথিবী সৃষ্টির আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে।
তার ছবির রচনায়ও একারনে প্রকৃ্তি আসে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে, ১৯৯২ সালে করা Hill of Dragon lily and those innocent people নামক সিরিজটিতে মানুষ, প্রকৃ্তি এবং তাকে ঘিরে যে জীবনযাত্রা তার এক সার্বিক রুপ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে তাঁর Allegorical Landscape ও ঠিক একই কথা বলে। আলোচনা প্রসঙ্গে শিল্পী আরো বলেন “আমরা তো বৃত্তের মধ্যে সারা বিশ্বকে দেখি এই বৃত্তটিকে যদি একটি ছোট ফুলের খুব কাছে নিয়ে যাই তবে কি দেখি? আমি এই দেখাটিকেই বড় করে উপস্থাপন করি বড় ক্যনভাসে।’’
এই উক্তিটির মধ্যে শিল্পীর শিল্পীসত্তার এক চরম সত্য নিহিত আছে, একজন প্রকৃ্ত শিল্পী কিন্তু তাঁর দৃষ্টি দিয়ে দেখা সৃষ্টিকে নতুন রুপে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করেন।প্রতিদিনের দেখা ঘরের পাশে ফুটে থাকা ফুলটি হয়তো নিতান্ত অবহেলায় ফুটে আবার হয়তো ঝরে যায়। কিন্তু শিল্পীর দৃষ্টি যখন তাকে তুলে আনে, পরম যত্নে উপস্থাপন করে নতুন গ্রহনযোগ্যতায় তখন মনোযোগ কারে আমাদের প্রতিদিনের বোকা দৃষ্টিকে, যে কদর দেয়নি সুন্দর প্রকৃ্তির। এইভাবেই শিল্পী দৃষ্টিসম্ভাবনার দ্বারগুলো খুলে দেয় মানুষের সামনে। মানুষ আবার নতুন করে আবিস্কার করে নিজেকে। নিজের গুরুত্ব অনুধাবন করে নতুন দর্শনে। যান্ত্রিক একঘেঁয়ে জীবন থেকে মুক্তি ঘটায় নিজের।
পাকিস্থানে থাকাকালীন সময়ে নীলুফার চামানের এক অভিজ্ঞতায় জানা যায়, তিনি তার এক বন্ধুর বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন এবং ঘরটি ছিল সমুদ্রের ধারে। স্বভাবজাত তাগিদে সমুদ্র ভ্রমনে তিনি যেতেন সৈ্কতে। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি লক্ষ্য করলেন সমুদ্রের পারে কিছু পাথর সমুদ্রের স্রোতে আসে আবার চলে যায়। এই নিত্যপরিবর্তিত পাথরগুলোর বাহারি রঙের সৌ্ন্দর্যে শিল্পী অবাক হন, কিন্তু আহত হন তাদের পরিবর্তনে। অবাকও হন প্রকৃ্তির এমন অমোঘ নিয়ম দেখে। শিল্পী তখন সেই যাযাবর পাথরগুলোকে সংগ্রহ করতে থাকেন পরম যত্নসহকারে। প্রতিটি পাথরের জন্য একটি করে কাগজের বক্স তৈ্রি করতে থাকেন যাযাবর পাথর গুলোকে আশ্রয় দেবার জন্য। কথা প্রসঙ্গে শিল্পী নিজেও বলেন “আমি আশ্রয়স্থল তৈ্রী করেছি প্রতিটি ভাসমান ঠিকানাবিহীন পাথরের জন্য’’। প্রাসঙ্গিকিতে একটি ঘটনা আমার মনে পরছে, একবার এক স্বাক্ষাতকার এ মাদার টেরিজা বলেছিলেন “এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ যদি একটি করে অবহেলিত শিশুর দায়িত্ব নেয় তবে আমার বোঝাটা অনেক হালকা হয়, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হয়।’’
শিল্প প্রসঙ্গে কোন এক মনিষী বলেছিলেন “শিল্প হচ্ছে এই পৃথিবীর কাছে একটি সুন্দর উপহার’’। সমাজে শিল্পী তার শিল্পের মধ্য দিয়ে সমাজকে সুন্দর ও সুশীল করে, ভুলে যাওয়া মানবিক অনুভুতির কথা সে মনে করিয়ে দেয় আমাদের বোকা মনগুলোকে। আর শিল্পীর এই অদৃশ্য সামাজিক দ্বায়িত্ববোধের চিত্রভাষা খুজে পাই শিল্পী নীলুফার চামানের শিল্পসৃষ্টিতে।